বাম রাজনৈতিক দলের উৎপত্তি, আদর্শ ও আধুনিক রাজনীতিতে প্রভাব



 রাজনৈতিক পরিসরে প্রায়শই শোনা যায় “বাম দল” বা “বাম রাজনীতি” শব্দ দুটি। তবে এ ধারণার প্রকৃত উৎস, আদর্শ ও আধুনিক রাজনীতিতে এর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা খুবই সীমিত। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, বামপন্থী রাজনীতির সূচনা ঘটে ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব থেকে।


ফ্রান্সের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে সেই সময় যারা রাজতন্ত্র এবং প্রচলিত ব্যবস্থার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, তারা অধিবেশন কক্ষে সভাপতির ডান পাশে বসেন। অন্যদিকে যারা গণতন্ত্র, জনগণের অধিকার এবং সামাজিক পরিবর্তনের পক্ষে ছিলেন, তারা বসেন বাঁ পাশে। এই অবস্থান থেকেই রাজনীতিতে “বাম” এবং “ডান” শব্দ দুটির ব্যবহার শুরু হয়। পরবর্তীতে এই বিভাজন থেকেই উদ্ভব হয় “বাম রাজনীতি” ধারণার।


বাম রাজনৈতিক দল বা বামপন্থীরা সাধারণত সমাজতন্ত্র, জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার রক্ষা এবং ধনী-গরিব বৈষম্য হ্রাস করার পক্ষে অবস্থান নিয়ে থাকেন। এরা মনে করেন, অর্থনীতি ও সমাজে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করতে রাষ্ট্রকে ভূমিকা পালন করতে হবে। ব্যক্তিগত মালিকানা ও পুঁজিবাদের পরিবর্তে তারা রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও সম্পদের সমবণ্টনে বিশ্বাসী।


বিশ্বজুড়ে বাম রাজনীতি বিভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি, কিউবার বিপ্লবী সরকার কিংবা ভেনেজুয়েলার সমাজতান্ত্রিক সরকার – সবকিছুই বামপন্থার বিভিন্ন বাস্তব প্রয়োগের উদাহরণ। এদের রাজনৈতিক দর্শন মূলত কার্ল মার্ক্স ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস প্রবর্তিত মার্কসবাদী তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।


বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও স্বাধীনতার পরপরই বাম রাজনীতি দৃশ্যমান হয়। ১৯৭২ সালে গঠিত হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), যারা শুরু থেকেই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আমূল পরিবর্তনের পক্ষে সোচ্চার ছিল। একই সময়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাসদসহ আরও কিছু বাম দল শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি মানুষের অধিকার নিয়ে রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।


বর্তমানে দেশে বাম রাজনীতির দৃশ্যমান প্রভাব কিছুটা কমে এলেও বিভিন্ন আন্দোলন, যেমন শ্রম অধিকার, নারীর নিরাপত্তা এবং পরিবেশ আন্দোলনে এদের সক্রিয়তা এখনো লক্ষণীয়। তরুণদের একাংশ ধীরে ধীরে আবারও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে, যা বাম রাজনীতির জন্য নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়।


রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিশ্বব্যাপী বৈষম্য, কর্পোরেট আধিপত্য এবং জলবায়ু সংকটের মতো বিষয়গুলো সামনে এলে বাম রাজনীতি আবারও জোরদার হতে পারে। অনেক দেশেই নতুন প্রজন্মের নেতারা এখন "নতুন বামপন্থা"র ধারণা নিয়ে এগিয়ে আসছেন, যা গণতন্ত্র ও সমাজকল্যাণকে একত্রে এগিয়ে নিতে চায়।


এদিকে বর্তমান রাজনীতিতে ডানপন্থী দলগুলো যেখানে অর্থনৈতিক মুক্তবাজার, ব্যক্তিগত মালিকানা এবং ধনীদের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেয়, সেখানে বামপন্থীরা সমাজে সকলের জন্য সমান সুযোগ ও ন্যায্যতার পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে থাকে।


বাম রাজনীতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়ানো এবং এর প্রকৃত আদর্শ তুলে ধরা আজকের দিনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সমাজে যখন বৈষম্য ও অসাম্যের বিস্তার ঘটে, তখন বাম রাজনীতির ভূমিকা পুনরায় আলোচনায় উঠে আসে।


রিপোর্টার: রাজনৈতিক ডেস্ক

সূত্র: গবেষণা ও বিশ্লেষণ

Previous Post Next Post